বারো রাজপুতের তেরো হাঁড়ি৷ কিন্তু বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ৷ এই তেরোস্পর্শের এমনই মহিমা যে কিছু পুরনো বাদ গেলে নতুনের যোগে সংখ্যাটা সেই তেরোই থাকে৷ যেমন চৈত্র শেষে চড়কের গাজন বন্ধ হওয়ার পর যোগ হয়েছে ঘোর বৈশাখে রবীন্দ্রপার্বণ৷ দিকে দিকে তার ‘কত যে বরণ কত যে গন্ধ, কত যে রাগিণী কত যে ছন্দ’, তার দিশা পাওয়া দায়৷
উপনিষদে কবিদের মনীষী আখ্যা দেওয়া হয়েছে কেননা তাঁরা কবি-দৃষ্টিতে ভবিষ্যৎকে প্রত্যক্ষ করতে পারেন৷ রবীন্দ্রনাথও তার ব্যতিক্রম নন৷ তাই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ খেয়ালবশে এক কবিতায় যা লেখেন, তা পরে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে৷ ‘কর্মফল’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘পরজন্ম সত্য হলে কী ঘটে মোর সেটা জানি/আবার আমায় টানবে ধরে বাংলাদেশের এ রাজধানী৷/গদ্যপদ্য লিখনু ফেঁদে, তারাই আমায় আনবে বেঁধে,/অনেক লেখার অনেক পাতক, সে মহাপাপ করব মোচন/আমায় হয়তো করতে হবে, আমার লেখার সমালোচন৷’ নিজের লেখা সম্বন্ধে কবি সচেতন থাকলেও, নিজের না লেখা সম্বন্ধেও যে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে সেকথা ধারণা করতে পারেননি তিনি৷
গ্রীষ্মের এই দাবদাহে কালবোশেখীর বড় একটা দেখা নেই৷ কেননা এক বঙ্গকবির প্রার্থনায় চেরাপুঞ্জি থেকে একটি নব মেঘদূত মরু দুবাই পৌঁছে সেখানে প্লাবনের সৃষ্টি করেছে৷ কিন্তু এই অবসরে গণমাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে৷ তথ্যের ভারহীন এই বিশেষ সত্য বিশেষভাবে প্রচারিত হচ্ছে যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধতা করেছিলেন৷ সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকলেই যে সেটা উড়িয়ে দিতে হবে, এমন কোনও কথা নেই৷
হতে পারে মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম৷ কবি হয়তো ভেবেছিলেন, বিশ্বভারতীর একটি প্রতিযোগী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন মোটেই কাম্য হতে পারে না৷ আবার এমনও হতে পারে, তিনি চেয়েছিলেন আলিগড়ের মতো ঢাকায় একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হোক৷ কিন্তু প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর দেখা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্র উভয় বিভাগেই হিন্দুপ্রাধান্য৷ সে কথা যাক৷
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নাকি জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি মুসলমানদের সম্বন্ধে লেখেননি কেন? সে ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের Iame excuse হলো- মুসলমানদের সম্বন্ধে তাঁর তেমন জ্ঞানগম্যি ছিল না৷ নোবেল ভাঙিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হলেন, সারা বিশ্ব ভ্রমণ করলেন, বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী দিলেন, ঢাকায় সংবর্ধনা লাভ করলেন আর ঘরের পাশে আরশিনগর মুসলমানদের সম্বন্ধে কিছুই জ্ঞানগম্যি হলো না৷ এটা একটা কথা হলো? তুমি ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী সম্বন্ধে কিছু জানলে না এদিকে বিশ্বমৈত্রীর জন্যে ছোটাছুটি করতে গেলে৷ বুঝলে না সেটা ব্যর্থ হতে বাধ্য৷ কেননা বিজ্ঞজনেরা বলেছেন, প্রথমত know thyself (আত্মানং বিদ্ধি), তারপরে Love thy neighbour, as thyself.
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য কৌশল করে ‘ঐকতান’ কবিতায় গেয়ে রেখেছিলেন, ‘আমার কবিতা আমি জানি, গেলেও বিচিত্রপথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী৷’ পরে যোগ করেছেন, ‘মাঝে মাঝে গেছি আমি ওপাড়ায় প্রাঙ্গণের ধারে, ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে৷’ এটা একটা কথা হলো? তুমি নেড়ানেড়ির কেত্তনের প্রতিবেশীদের মধ্যে ভালোই প্রবেশ করতে পারলে আর অন্যদিকে বীর বাহাদুর বক্তিয়ার খিলজি আগমনের পর বাংলার ঘরে ঘরে যে তুর্কিনাচন ও আরবি বচনের সৃষ্টি হলো, সে সম্বন্দে কিছুই জানলে না৷ তাজ্জব কি বাত!
রবীন্দ্রনাথ যদিও আবার কাব্য করে বললেন, ‘জীবনে জীবন যোগ করা, নাহলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পশরা৷’… ‘সত্যমূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি ভালো নয়, ভালো নয় নকল সে সৌখীন মজদুরি৷’ আরে আপনার সারাটা জীবনই তো ‘সৌখীন মজদুরি’৷ ব্রিটিশভজা প্রিন্স দ্বারকানাথের নাতি হয়ে প্রজাদের রক্তচোষা ঠাকুর এস্টেটের পয়সায় সারাজীবন আমোদ করে অলীকবাবুর ভূমিকায় বায়বীয় ভুড়ভুড়ি কেটে গেলেন! আর একটা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সম্বন্ধে স্পিকটি নট৷ বুর্জোয়া বুজরুকি আর কাকে বলে!
রবীন্দ্রনাথ মহাকবি ‘মহাপুরুষ’ নামে পরিচিত হলেও আসলে ছিলেন ‘কাপুরুষ৷’ তিনি বোধ হয় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের দশা দেখে৷ ওসমান, আয়েষা ও মতিবিবির স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র যে ‘কম্যুনাল’ ছিলেন তা আমরা পণ্ডিতপ্রবর বুদ্ধুরাম ভট্টাচার্যের মুখে শুনেছি৷ আর শরৎচন্দ্র তাঁর ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে বাঙালি ও মুসলমানদের ফুটবল খেলার কথা লিখে স্বতই বিদ্বেষ মনোভাবের পরিচয় দেন৷ তবে আমরা ভুলে যাই যে কথাসাহিত্যিক আসলে জীবন থেকেই তাঁর লেখার রসদ গ্রহণ করেন৷ তখনকার কালে বাঙালি ও মুসলমানদের যে পরিচিতিতে ভেদ ছিল সেকথা লিখে গেছেন ঢাকার বিদগ্ধ অধ্যাপক আহমদ শরীফ৷ দীর্ঘদিন মুসলমানরা, উর্দুকে তাদের স্বজাতীয় ভাষা বলে নিজেদের ‘রাজার জাত মুসলমান’ রূপে পরিচয় দিতে আত্মপ্রসাদ অনুভব করত৷ এমনকি গিরিশ সেন যখন বাংলায় কোরান অনুবাদ করলেন, তখন সেই বাঙালিয়ানায় মুসলমান সমাজে গেল গেল রব পড়ে গেল৷
রবীন্দ্রনাথ বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, কিন্তু না জেনে কোনও সম্প্রদায়কে ছুঁলে ছত্ৰিশ ঘা৷ অনেকদিন পরে কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় পশ্চাত দিক থেকে এক মুসলমান গুরুর ছবির একটি silhouette দেওয়া হয়েছিল বলে পরে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হয়৷ অথচ মুসলমানদের ছবি যত্রতত্র কিছু অপ্রতুল নয়৷ কিন্তু কে যায় ওসব সূক্ষ্ণ বিচারে৷তাই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ তাঁর অজানা জীবন ও সম্প্রদায় সম্বন্ধে মৌন থাকাই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন৷
কিন্তু বেচারি রবীন্দ্রনাথ, কথা কইলেও দোষ, না কইলেও দোষ৷ রবীন্দ্র পরবর্তী কবিরা তাঁদের কবিতায় অনর্গল রবীন্দ্রনাথকে হেনস্থা করে প্রচারে আসার চেষ্টা করলেও রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য বর্জিত হলেই ক্ষুব্ধ থেকে বিক্ষুব্ধ৷ জীবনের উপান্তে রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা লিরিক কাব্যের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠায় বাংলা ‘কাব্যপরিচয়’ নামে সংকলন করলেন তখন জীবিত যাঁরা বাদ পড়লেন তাঁরা কবির ওপর খড়গহস্ত হয়ে উঠলেন৷
এঁদের মনে হয় হয়েছে সেই দশা— রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণও করা যায় না আবার বর্জনও করা যায় না৷ পদ্মাপারের বুজুর্গদেরও হয়েছে সেই একই দশা৷ রবীন্দ্রনাথকে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করতে পারে না, আবার ত্যাগও করতে পারে না৷ ঢাকায় থাকাকালীন টিভি সিরিয়ালে দেখেছি, শিক্ষিত ভদ্রজনের বসবার ঘরে রবীন্দ্রনাথের ছবি শোভমান৷ অবাক হয়ে যখন কবিবন্ধু বেলালভাইকে (চৌধুরী) জিজ্ঞেস করলুম, জাতীয় কবি নজরুলের বদলে রবীন্দ্রনাথের ছবি আপনাদের ঘরে ঘরে কেন বিরাজমান? তখন তিনি কৌতুকভরে উত্তর দিলেন, কেন রবীন্দ্রনাথ কি কেবলমাত্র আপনাদের নাকি!শিলাইদহে না এলে তিনি কি নোবেল পুরস্কার পেতেন!
রক্তাক্ত দেশভাগ সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর একদা কর্মভূমি পূর্ববঙ্গে প্রাণের গান হয়ে ওঠে৷ সেই গান হয় প্রতিবাদের ভাষা, পূর্ববঙ্গের নিজের সংস্কৃতিকে ফিরে পাওয়ার আশা, ও সর্বোপরি আত্মপরিচয়কে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করার প্রবল সক্রিয়তা৷
আসলে পদ্মাপারে রবীন্দ্রনাথের অবস্থা হয়েছে— তাঁরে না ফেলতে পারি, না গিলতে পারি৷ কারণ রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সত্তার এমন মর্মমূলে স্থান করে নিয়েছেন যে তাঁকে ত্যাগ করা শক্ত৷রবীন্দ্রনাথের কথা যে, ‘আমার গান বাঙালিকে গাইতেই হবে’, সেকথা এপার বাংলা ওপার বাংলা— দুই দেশ সম্পর্কেই সত্য৷রক্তাক্ত দেশভাগ সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর একদা কর্মভূমি পূর্ববঙ্গে প্রাণের গান হয়ে ওঠে৷ সেই গান হয় প্রতিবাদের ভাষা, পূর্ববঙ্গের নিজের সংস্কৃতিকে ফিরে পাওয়ার আশা, ও সর্বোপরি আত্মপরিচয়কে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করার প্রবল সক্রিয়তা৷ বাংলাদেশের উদ্ভব তথা আত্মোদ্বোধনের মন্ত্ররূপে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রেরণার স্বীকৃতিতে ঢাকার সঙ্গীত ও সংস্কৃতি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ, ওয়াহেদুল হক একটি প্রবন্ধের নামকরণ করেছেন, ‘একটি দেশের জন্ম ও রবীন্দ্রনাথ’৷
সেই প্রবন্ধের ছত্রে ছত্রে পরিস্ফুট হয়েছে বাংলাদেশের নবজাগরণের রবীন্দ্রনাথের দান৷ ওয়াহেদুল ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের টানে হয়ে উঠলেন সংগ্রামী সাংস্কৃতিক ও সাঙ্গীতিক আন্দোলনের হোতা৷ তিনি লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে জন্ম নিলেন, কথাসাহিত্যিক হয়ে নয় একেবারেই গান হয়ে৷ যে গানকে পাকিস্তানি বাঙালি মাত্রই দশ বছরে বানিয়ে ফেলল মুক্তির মন্ত্র৷’…
উনিশশো চুয়ান্নতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে’— রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে মাতিয়ে তুললেন কলিম শরাফি৷বীরভূমের সন্তান, রবীন্দ্রানুরাগী কলিম শরাফি ছিলেন, শম্ভু মিত্র পরিচালিত ‘বহুরূপী’ নাট্যসংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য৷ তিনি ঢাকায় গিয়ে শুরু করলেন রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘গীতাঞ্জলি’৷
‘তারপর আর একজন শান্তিনিকেতনি ভাবধারার শিষ্য আবদুল আহাদ, আকাশবাণী কলকাতা থেকে গিয়ে যোগ দিলেন ঢাকা রেডিওতে৷ রবীন্দ্রচর্চায় পরিশীলিত আহাদ ঢাকা রেডিও-তে বিভাগপূর্ব ঢাকার শিল্পীদের নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারে এক উজান স্রোতের জোয়ার আনলেন৷ পাকিস্তান সরকার যখন চরম রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার-বিরোধী হয়ে গণমাধ্যমে তার পরিবেশন নিষিদ্ধ করল, তখন এক সরকারি আমলা এক উদ্ভট ফরমান জারি করেন, কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত নতুন করে রচনা করার৷ সেই কঠিন সময়ে এলো রবীন্দ্রশতবর্ষ এবং পূর্ব পাকিস্তান মেতে উঠল৷’
ওয়াহেদুল হক বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে জন্ম নিলেন এভাবে, কবি সাহিত্যিক হয়ে নয়, একেবারেই গান হয়ে৷ যে গানকে পাকিস্তানি বাঙালি মাত্রই দশ বছরেই বানিয়ে ফেলল মুক্তির মন্ত্র৷ এল একষট্টি৷ এল বৈশাখ৷ পঁচিশে বৈশাখে আরম্ভ হল ঢাকায় এগারো দিনব্যাপী শতবার্ষিকী উৎসব৷ শত শিল্পী উদ্বোধনী সম্মেলন গাইলেন ‘নে নূতন’৷ মঞ্চে শ্ৰেষ্ঠ সকল শিল্পী গাইল রবীন্দ্রনাথের তিনশোর মতো গান, নৃত্যশিল্পীরা নৃত্যনাট্য করল চারটি, নাটক হল তিনটি, রবীন্দ্রচিত্রের প্রদর্শনী হল, আলোচনাসভায় কথা বললেন সারস্বত সমাজের তাবড় নেতারা৷ অনুষ্ঠানস্থলটি তীর্থে পরিণত হয়েছিল৷ ছোঁয়াচে রোগের মতো এ ছড়াল সারা পূর্ব পাকিস্তানে৷ সর্বত্র শতবার্ষিকী৷’
ওয়াহেদুল হকের বক্তব্য, ‘অলক্ষ্যে যেন বাংলাদেশের নবজন্মের প্রথম প্রতিশ্রুতি শুরু হলো৷ এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্দের তিনটি ধাপ— বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, একষট্টির রবীন্দ্র-শতবর্ষ এবং শেখ মুজিবকে কারান্তরাল থেকে আনার গণঅভ্যুত্থান, উনসত্তরে৷…’ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, অঙ্কুরে বিনাশ করা এই উৎসব৷ আয়োজকদের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ কিন্তু সরকারকে থামতে হয়েছিল শতবার্ষিকীর প্রধান উদ্যোক্তা জহুর হোসেনকে ধরবার প্রশ্নে৷’
ওয়াহেদুল লিখেছেন, ‘কেবল শতবার্ষিকীর সার্থক উদ্যাপনেই বাঙালির দম ফুরিয়ে গেলে রাষ্ট্রটি আর হত না৷ নানা দলের নামে অনুষ্ঠানগুলি হলেও অন্তরালে ছিল একটিই ক্ষুদ্র ঘনসংবদ্ধ বন্ধুসভা৷ তাঁরা ঠিক করলেন ঘরে ফেরা নয় এই মুহূর্তে, রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে ভাঙতে হবে অচলায়তন, গড়তে হবে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ৷’ কোন রবীন্দ্রনাথ, নানা রবীন্দ্রনাথের মালা থেকে? পারফরমার্স ট্যাগোর৷ অনুষ্ঠানসম্ভব রবীন্দ্রনাথ৷ একই সঙ্গে হাজার মানুষে পৌঁছতে পারা রবীন্দ্রনাথ৷ গানের, আবৃত্তির, নাটকের, নৃত্যের রবীন্দ্রনাথ৷ বিকীরণসম্ভব রবীন্দ্রনাথ৷ বুদ্ধিগ্রাহ্য নয় ততটা, যতটা বোধগম্য রবীন্দ্রনাথ৷ রূপময় রবীন্দ্রনাথ৷
শেখ মুজিবের সপরিবারে নৃশংস হত্যার পর বাংলাদেশে মিলিটারি জমানাতেও রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশের হৃদয় হতে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি৷ ভাষাদিবসের মতোই, রবীন্দ্র ভাবনায় রমনার বটমূলে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানের সুরে পয়লা বৈশাখের নববর্ষ-বরণ হয়েছে জাতীয় উৎসব৷
‘রবীন্দ্রনাথই কেন?’ যাতে পাকিস্তানের ধর্মীয় মায়াতন্ত্র ভেদ করে বাঙালি তার স্বভাবে ফিরতে পারে, সমন্বয়ধর্মী সৃজনশীলতার, গতিশীলতার স্বভাব ভাঙতে পারে সব বেড়া, পারে শোনপাংশদেরকে ভাই বলে গলা জড়িয়ে ধরে সাম্প্রদায়িক ডোবা থেকে জাতীয়তার মহামিলনক্ষেত্রের উদারতায় উত্তীণ হতে৷ এই মহাযাত্রায় সিংহদ্বার যেমন, তেমনি পান্থজনের সখাও রবীন্দ্রনাথ৷ রবীন্দ্রনাথ মানে সংহত বাঙালি৷ তাঁর বাঙ্ময়ে, তাঁর বাগাতীত সব রূপ-অরূপ সন্ধানে৷
‘বিস্তৃত হলো বন্ধুসভা৷ সভাপতি হলেন কবি সুফিয়া কামাল৷ তাঁর পাশে থাকলেন জহুর হোসেন৷ প্রকৃত কাণ্ডারী মোখলেসুর রহমান সিধু, তাঁর দুই সেনানী, সন্জীদা ও আহমেদুর রহমানকে নিয়ে৷ তিনটি ঋতু উৎসব বসন্ত, বর্ষা, শরৎ এবং বারো মাসে ষোল গীতানুষ্ঠান করে এই নতুন সাংস্কৃতিক যোটক বাঙালির মন জয় করল অচিরে৷ শেষাবধি পহেলা বৈশাখের বাংলা নববর্ষকে জাতীয় উৎসবে পরিণত করল তারা৷ ‘ছায়ানট’ নামটি গেঁথে গেল বাঙালির ঘুরে দাঁড়াবার দৃপ্ত প্রয়াসটির সঙ্গে৷
ওয়াহেদুল হকের কথায় ‘গানঘন এই দিনগুলি, শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি-সনদ ছয় দফা দিলে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজনৈতিক আন্দোলনেও৷ পঁয়ষট্টি থেকে উনসত্তর, বাঙালির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ সময়৷ মিছিলে মিছিলে, গানে গানে রবীন্দ্রনাথ৷ একষট্টি থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত নতুন মাত্রা পাচ্ছিল৷ এই সময়ে তাঁর গান প্রচণ্ডভাবে রাজনৈতিক বোধনসঙ্গীতের ভূমিকা পেয়ে যায়৷ আইয়ুব যেতে বাঙালির জনজীবনের কেন্দ্রীয় মঞ্চে চলে এল রবীন্দ্রনাথের ‘প্রাণপোড়ানো গানের আগুন জ্বালা’৷ উনসত্তরে এই থেকে গণঅভ্যুত্থান৷ ঢাকার রাজপথ মিছিলে মিছিলে টালমাটাল৷ আর তার সঙ্গে সেই ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো’— থেকে নেওয়া ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো৷’
সেই আগুনঝরা দিনগুলি সম্বন্ধে ওয়াহেদুল হক লিখেছেন, ‘একাত্তরের মার্চে গণহত্যা শুরু করল পাকিস্তান৷ চিরকালের অসামরিক বাঙালি খালি হাতে দাঁড়াল তার বিরুদ্ধে৷ গণহত্যার নয় মাসে পাকিস্তানি সেনা হত্যা করেছে দিনে গড়ে দশ হাজার বাঙালি৷ নৃশংসতার এক সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে বাঙালি এবং হানাদারকে পর্যুদস্ত করেছে, লেজ গুটিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য করেছে৷ সেই কোটি যোদ্ধার কণ্ঠে তখন একটাই গান— ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’৷ একটাই জয়ধ্বনি— ‘জয় বাংলা’৷ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরে অনেক ষড়যন্ত্র পেরিযে রবীন্দ্রনাথের প্রাণনাময় গানটিই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হল৷ স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্রিক বিপর্যয় সত্ত্বেও হয়তো সেকারণেই, রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব প্রতিনিয়ত যাচ্ছে বেড়ে৷ রবীন্দ্রনাথকে বাঙালিত্বের পূর্বাংশ পেয়েছে সমধিক গানের ভেতর দিয়ে৷’
পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের সপরিবারে নৃশংস হত্যার পর বাংলাদেশে মিলিটারি জমানাতেও রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশের হৃদয় হতে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি৷ ভাষাদিবসের মতোই, রবীন্দ্র ভাবনায় রমনার বটমূলে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানের সুরে পয়লা বৈশাখের নববর্ষ-বরণ হয়েছে জাতীয় উৎসব৷ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীসংস্থার উদ্যোগে ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত উৎসব’-এর সূচনা হয়েছে৷ এরশাদশাহীর বিরুদ্ধেও গণকণ্ঠ সরব হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে৷
কিমার্শ্চম্, রবীন্দ্রনাথ পদ্মাপারের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সম্বন্ধে কিছু না লিখেও হয়ে উঠেছেন তাদের জীবনের পরম প্রেরণা৷ বিশেষ করে অস্তিত্বের সংকটকালে ও স্বপ্রতিষ্ঠা হওয়ার সংগ্রামে৷ সেখানেই রবীন্দ্রনাথ জীবনে দীর্ঘ ছায়া ফেলেছেন৷